বিশেষ প্রতিনিধি :
লক্ষ্মীপুরে গত বছরের তুলনায় সূর্যমুখী ফুলের চাষাবাদ বেড়েছে। সরকারি উদ্যোগে কৃষি প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন এবং বিভিন্ন প্রদর্শনী প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় সূর্যমুখী চাষে এমন অভূতপূর্ব উন্নতি। অনুকূল আবহাওয়া এবং সম্ভাব্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে আগামীতে লক্ষ্মীপুর জেলা সূর্যমুখীর দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় কৃষিবিদগণ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সূর্যমুখী সারাবছর চাষ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ মাসে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। চাষাবাদের মাত্র ১১০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে এ ফসল ঘরে তোলা যায়। ২০২০-২১ইং অর্থ বছরের চলতি মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলায় ১ হাজার ৮৭৮ বিঘা বা ৪৭৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষাবাদ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩২ গুণ বেশি।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৮৫, রায়পুরে ১৫৫, কমলনগরে ১০৫, রামগতিতে ৮০ এবং রামগঞ্জে ৫০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে। গত অর্থ বছরে জেলায় মাত্র ১৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর চাষাবাদ হয়েছিল। এতে ৪৩ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন হয়। যে কারণে চলতি বছর জেলায় সূর্যমুখীর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল মাত্র ৩০ হেক্টর জমিতে ৭০ মেট্রিক টন ফসল। কিন্তু এখন চাষাবাদ বেশি হওয়ায় ফসল উৎপাদনের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রাও বেড়েছে।
জেলা সদর উপজেলার দিঘলী, কুশাখালী ও ভবানীগঞ্জসহ রায়পুর, কমলনগর, রামগতি ও রামগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সূর্যমুখী ফুলের ক্ষেত পরিদর্শন করে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা যায়। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কৃষকরা নিয়মিত ফসলের যত্ন নিচ্ছেন। ফলে সূর্যমুখীর বাম্পার ফলন আশা করা হচ্ছে।
এ বছর প্রথমবারের মতো পাঁচ বিঘা জমিতে বারি সূর্যমুখী-৩ চাষাবাদ করেছেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এলাকার কৃষক মো. ওসমান গণি বলেন, সূর্যমুখী চাষাবাদ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেক আমাকে সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে কৃষি অফিস থেকে বীজ ও বিভিন্ন প্রকার সার বিনামূল্যে পেয়ে আমি চাষাবাদ শুরু করি। এখন পর্যন্ত আমার ক্ষেতে ফসলের অবস্থা খুবই ভালো দেখা যাচ্ছে। আল্লাহর রহমতে আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী ২০-২৫ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যাবে।
কৃষক মো. আবদুল মান্নান বলেন, সূর্যমুখী চাষে খরচ কম, পরিশ্রমও তুলনামূলকভাবে কম। এখানে তৃপ্তি আছে। সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য খুবই ভালো লাগে। তাছাড়া সূর্যমুখীর বীজ থেকে শুরু করে সবকিছুই কাজে লাগানো যায়।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেক বলেন, স্বল্প সময় এবং স্বল্প খরচে অধিক লাভ, সাথে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য সূর্যমুখী ফুল চাষে পাওয়া যায়। এখানকার আবহাওয়া ও মাটি সূর্যমুখী চাষের উপযোগী। তবুও অনভিজ্ঞতার কারণে কৃষকরা সূর্যমুখী চাষে সাহস পাচ্ছিলেন না। এ বছর কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করায় বহু কৃষক প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী চাষ করেছেন। এ বছর উৎপাদন ভালো হলে আগামীতে সূর্যমুখীর চাষাবাদ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের নবীনগর এলাকায় সূর্যমুখী ফুলের একটি ক্ষেতে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ সময় একাধিক দর্শনার্থী জানান, সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য আমাদের আকৃষ্ট করে। তাই সুযোগ পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে এসেছি সূর্যমুখী ফুল দেখার জন্য।
লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আবদুল গাফফার বলেস, ক্ষতিকারক ইরোসিক এসিডমুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্য তেলের জন্য সূর্যমুখীর তেল খুবই উপযুক্ত। বর্তমান বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া সূর্যমুখী ফুলের পাশাপাশি মৌমাছি চাষ করে প্রচুর পুষ্টি সমৃদ্ধ মধু উৎপাদন সম্ভব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. বেলাল হোসেন খান বলেন, কৃষি প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন এবং প্রদর্শনী প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৌমাছি চাষ করে মধু উৎপাদনের পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। চলতি অর্থ বছরে প্রত্যেক কৃষককে বিনামূল্যে এক কেজি সূর্যমুখী বীজ ও বিভিন্ন প্রকারের সার ২০ কেজি করে জেলার এক হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়। কৃষি পুনর্বাসনের আওতায় বিনামূল্যে ১ কেজি করে বীজ দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত আরও ২ হাজার কৃষককে সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এছাড়াও প্রদর্শনী প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ২৫৫ জন কৃষকের প্রত্যেককে সূর্যমুখী চাষে বিনামূল্যে ৭৫০ গ্রাম বীজ ও ১০৫ কেজি করে সার দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার লক্ষ্মীপুরে প্রায় ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন সূর্যমুখী বীজ বা দানা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে সূর্যমুখীর উৎপাদন বাড়ানো গেলে লক্ষ্মীপুর সূর্যমুখীর দেশে পরিণত হবে।
Leave a Reply