প্রতিদিনের খবর ডেস্কঃ
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইনে পরীক্ষা নিতে গত ২৪ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। সভায় সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে যে মতামত পাওয়া গেছে তা সাধারণ একটি মতামত কোন রোডম্যাপ পাওয়া যায়নি। তবে একটি বেসিক ডকুমেণ্টটা তৈরি করা হয়েছে। যেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করছে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা প্রয়োজন। বর্তমানে পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে গ্রহণ করা সম্ভব না হলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিভাবে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া যায় সেই বিষয়ের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। পরে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য দুটি আলাদা কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে আয়োজনের জন্য সুপারিশ করতে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন-বুয়েটের সিএসএই ডিপার্টমেণ্টোর প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন), মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, যশোর শিক্ষাবোর্ডের প্রতিনিধি, বেডুর প্রতিনিধি, এটুআই প্রতিনিধি, নটরডেম ও সেণ্ট জোসেফ কলেজের প্রতিনিধি। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এসএম আমিরুল ইসলাম আজকালের খবরকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে চলছে এভাবে আসলে চলতে পারে না। করোনা চলে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব না আবার অসম্ভব বলে কিছু নেই। বিকল্প রাস্তা বের করার চেষ্টা করছি। বিশ্বের কোনো কোনো দেশ অনলাইনে কিভাবে পরীক্ষা নিচ্ছে তার খোঁজ নিচ্ছি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে রোডম্যাপ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিবো।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগমকে। কমিটির সদস্য করা হয়েছে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, মাউশি ও এটুআই প্রোগ্রাম প্রতিনিধি। আর সদস্য সচিব করা হয়ে ইউজিসির পরিচালককে (আইএমসিটি)। উভয় কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি দেশে-বিদেশে অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বর্তমান প্রাকটিসগুলো পর্যালোচনা করে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী রোডম্যাপ প্রণয়ন করে আগামী ১২এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতি ও ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম আজকালের খবরকে বলেন, আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে তার খোঁজ খবর নিয়ে সামারি তৈরির কাজ করছি। লক ডাউন হয়ে যাওয়ায় কমিটির সদস্যদের নিয়ে আগামী ২৪ তারিখ সভা করবো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া কঠিন। ইণ্টাারনেটের গতি অনেক স্লো। সমস্যা হচ্ছে কভিড। এটা কত বছর চলবে কেউ বলতে পারছেন না। শিক্ষা ব্যবস্থা তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে রক্ষার জন্যই অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৭ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০১৮’ এর আওতায় গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটির দ্বিতীয় সভায় অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্বান্ত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং এট্আুইকে যৌথভাবে এ সিদ্বান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৩ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও অর্থ) সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর/সংস্থা, এট্আুই ও বুয়েট এর প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। উক্ত কমিটির সদস্যরা একধিক সভা করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য গত ২৪ মার্চ সভা ডাকা হয়।
ওই কমিটির প্রতিবেদনে অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের ঝুঁকি, সমস্যা এবং পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপযোগী অনলাইন পরীক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, পরীক্ষা পদ্ধতি রিডিজাইনিং, মূল্যায়ন পদ্ধতি রিডিজাইনিং, অনলাইন প্রক্টরিং ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো হলো-অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের লক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ (কম্পিউটার, ব্যান্ডউইথ, বিদু্যূৎ সংযোগ ও সরবরাহ, সফটওয়্যার ইত্যাদি নিশ্চিতকরন), অনলাইন পরীক্ষা বিষয়ক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান, সকল শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করার আগে পাইলটিং করা। প্রাথমিকভাবে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ উপযোগী ভৌত, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন ও বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশে পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি বা কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নের জন্য বিষয় বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপকমিটি গঠন করে তাদেরকে সময়াবদ্ধ দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার (উন্নয়ন) গত ২৪ মার্চের সভায় বলেন, কমিটির সদস্যরা অভিজ্ঞতা এবং মতামতের আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
সভায় বুয়েটের সিএসএই ডিপার্টমেণ্টোর প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, বুয়েটে আন্ডার গ্রাজুয়েট সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে কম্পিউটার, কম্পিউটারের গতি, ব্যান্ডউইথ, সংযোগ, সফটওয়্যার, পরীক্ষা উপযোগী পরিবেশ, প্রযুক্তিগত ও কারিগরি ইত্যাদির সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা তিন ঘণ্টাা হয়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রশ্নের উত্তর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে আপলোড করার সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বুয়েটে যেভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেটি প্রকৃত পক্ষে অনলাইন পরীক্ষা নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সিস্টেমের সঙ্গে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিস্টেমের মিল নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্সকে শর্ট করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা তিন ঘণ্টা নেওয়া হয়। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে অনেক সময় লাগে। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ তৈরি করে অনেক সময় উত্তরপত্র শেয়ার করে। তিনি আরো বলেন, টোফেল, জিআরই ইত্যাদি পরীক্ষা এমসিকিউ টাইপে অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া হয়। অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে হলে ধারাবাহিক মূল্যায়নে যেতে হবে। এছাড়া তিনি অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ল্যাব টেস্ট নেওয়া কঠিন ও চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন।
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) কাজী মনিরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের নৈতকতা বিষয় গুরুত্ব না দিয়ে কিভাবে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা সিস্টেম চালু করা যায় সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রশ্ন করার পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনের উপর কাজ করার মতামত দেন তিনি।
মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব না হলেও স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অভ্যান্তরীন পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে।
মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্তরভিত্তিক পরীক্ষার চিন্তা করা যেতে পারে। স্বাভাবিক পরীক্ষার সময় যেমন শিক্ষক-অভিভাবক-সোসাইটি সম্পৃক্ত থাকে তেমনি অনলাইন পরীক্ষার সময়ও তাদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারলে ফলাফল ভালো হবে।
সভায় অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন পরিচালক বলেন, একটি স্কলারশিপের জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করে ১০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের সময় অনেক সমস্যা সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১০ হাজারের মধ্যে সাত হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে সেখান থেকে প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছিল। এনএমএস।
Leave a Reply