……..লেখক : সাংবাদিক মো. আলাউদ্দিন
মহান রাব্বুল আল আমিন পথহারা, দিশাহারা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে খোদাদ্রেহীদের সাথে মিশে গিয়ে বিপথগামীদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। এই ধরাধামে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিদায়ের পর ইসলাম প্রচারের জন্য সুমহান দায়িত্ব বর্তায় ওলামায়ে কেরাম, গাউস-কুতুব ও আউলিয়ায়ে কেরামদের উপর। আউলিয়াগণ হলেন, আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও মোহাম্মদীয় ফুল বাগানের মালী। এদের কাজ হচ্ছে মানুষকে সৎ কাজে আদেশ দেওয়া এবং অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ আউলিয়ায়ে কেরাম ও ওলামায়ে কেরামদের মধ্যে অন্যতম আলেম ও ওলি ছিলেন, নোয়াখালীর বিখ্যাত ওলিয়ে কামেল মরহুম মৌলভী হামিদ উল্যা (বুড়া হুজুর) (রঃ) সাহেব।
জন্ম ও পরিচয় :
মরহুম বুড়া হুজুর (রঃ) অবিভক্ত নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফছিহ গাজী। তিনি ২ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম হামিদ উল্যা কিন্তু তিনি বুড়া হুজুর নামে সবার কাছে পরিচিত। তাঁর পিতাও ছিলেন, একজন বড় আলেমে দ্বীন। তাঁর পিতা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কোরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জন করে হাতিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কোরআন হাদীসের খেদমত করেন।
শিক্ষা জীবন :
মরহুম বুড়া হুজুর (রঃ) তাঁর পিতার নিকট থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। পরে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল উচ্চ ডিগ্রীলাভ করেন।
কর্ম জীবন :
তিনি শিক্ষা জীবন শেষ করে শিক্ষকতায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। সর্ব প্রথম তিনি বরিশাল জেলার উজিরপুর গ্রামে একে ফজলুল হক সাহেবের বাড়ির সামনে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, উপ মহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক সাহেব উক্ত মাদ্রাসা থেকে মরহুম হামিদ উল্যা সাহেবের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এক সময় মাদ্রাসাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে হলে তিনি সেখান থেকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্ব আলাদাদপুর গ্রামে আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি একই উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পশ্চিম বাজারে একটি দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তৎকালীন জমিদার কালী নাথ গুহের সাথে মতানৈক্য হলে তিনি মাদ্রাসাটি স্থানান্তর করে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানউল্যাপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে মাদ্রাসাটি চন্দ্রগঞ্জ কারামতিয়া ট্রিপল কামিল মাদ্রাসা নামে সুপরিচিত। একইস্থানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, চন্দ্রগঞ্জ জামে মসজিদ যাহা বর্তমানে বুড়া হুজুর (রঃ) জামে মসজিদ নামে সুপরিচিত। এলাকাবাসীর সহযোগীতায় তিনি ৩ একর ৩৪ শতাংশ জমির উপর উক্ত মাদ্রাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনের খেদমত চালিয়ে যান।
উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সারাদেশে সমাজ আলোকিত করেছেন। তারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। অত্র মাদ্রাসায় তিনি একটানা ৪৩ বৎসর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। মসজিদ ও মাদ্রাসাটি আজ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম এবং সুখ্যাতি অর্জন করেছে। বর্তমানে এলাকাবাসীর সহযোগীতায় মসজিদটিতে মাষ্টার প্ল্যানের কাজ চলছে। প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১টি সুউচ্চ মিনাবার আছে। মসজিদটিতে সুপরিসর জায়গা, জেনারেটর সার্ভিস, আধুনিক শৌচাগার, অজুখানা এবং পানি সরবাহের আধুনিক সুব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি শুক্রবার জুম্মার দিনে মসজিদটিতে নামাজ আদায় করার জন্য বহু দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মুসল্লী জমায়েত হন।
জীবনযাপন :
তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করেছিলেন। সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। অহংকার ও লৌকিকতার মোহে আসক্ত ছিলেননা তিনি মানুষকে মনে প্রাণে ভালোবাসতেন। পাড়াপ্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকতেন। অত্র এলাকার সকলের প্রাণের প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। এলাকার মানুষ যেমনি শ্রদ্ধা করতেন তেমনি ভালোবাসতেন তাঁকে। তাই এলাকাবাসী তাঁকে বুড়া হুজুর উপাধিতে ভূষিত করেন। এতে তাঁর মূল নাম মৌলভী হামিদ উল্যা অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়।
ইবাদত বন্দেগী :
তিনি সারাদিন ছাত্রদেরকে কোরআন হাদীসে জ্ঞান দানের পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য লাভে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। বেশী বেশী কোরআন তেলাওয়াত, জিকির আজগার, তাসবীহ্ তাহলীলে ব্রত থাকতেন। বিশেষ করে গভীর রাতে নফল নামাজ ও তাহাজ্জুদ নামাজে সময় কাটিয়ে দিতেন।
ইন্তেকাল :
ইসলামের এই মহান খাদেম মরহুম বুড়া হুজুর (রঃ) দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে ১৯৪৮খ্রিঃ সালের জুন মাস মোতাবেক ৮ই জ্যেষ্ঠ ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তারই প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও মসজিদের সম্মুখ অংশে তাঁকে চিরদিনের জন্য সমাহিত করা হয়। আমরা মহান এই বুজুর্গানে দ্বীন মহান ব্যক্তির আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমিন।
Leave a Reply