মিশন জীবন, রোজার মাস, সহনশীলতা ও করোনায় সম্মুখ যোদ্ধাদের আচরণ।
২০০৯ সালে প্রথম মিশনে লাইবেরিয়ায় যাই। সেখানে গিয়ে মানুষজনের আচার আচরণ দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হয় যে, কেন আসলাম এইখানে। এইখানের মানুষজন তো নিয়ম নীতিতে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ফুটপাত ছাড়া কোন মানুষ হাঁটে না, গাড়িতে উঠে সিট বেল্ট পড়ে, বাজারে গেলে অস্বাভাবিক দাম হাঁকায় না, মারামারি করে নিজেরাই থানায় চলে আসে মীমাংসা করার জন্য। আরো দেখি যে, প্রায় ৫০% মানুষ দিনে একবেলা খেয়ে থাকে কিন্তু হাত পাতে না, শুধুমাত্র শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী কিছু ব্যক্তি ছাড়া। তখন আমাদের দেশের অন্য পুলিশ অফিসারদেরকে জিজ্ঞাসা করে ও ইনডাকশন ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, লাইবেরিয়ার সিভিল ওয়ারে প্রায় ৫ লাখ লোক মারা যায় আর উক্ত সিভিল ওয়ারে আর্মি পুলিশের অনেক সদস্যই অংশগ্রহণ করেছিল এবং মৃত্যুবরণও করেছিল।
বর্তমানে যে পুলিশ বা আর্মি ফোর্স আছে তার মধ্যে ৯০% ই নতুন।
তাই তাদেরকে পুলিশিং শিক্ষা দেয়াই ছিল আমাদের মূল কাজ। আর আর্মিদের কাজ ছিল তাদের দেশের আর্মিকে দক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা।
তাদের সাথে কাজ করার সময় লাইবেরিয়ার জনগণের সাথেও মিশতে হয়েছে। তখন তাদের জনগণের আচার আচরণে অনেকটা অবাকই হয়েছি। তারা আচার আচরণ নম্রতায় ভদ্রতায় আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। যাই হোক, আমি সর্বোচ্চ ভালোভাবে চেষ্টা করেছি লাইবেরিয়ার পুলিশ ও জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য।
সমান ১ বছর কাজ করে মিশন থেকে ফিরে আসার সময় তাদের কাছ থেকে কিছুটা বদান্যতা নিয়ে আসি।
কিন্তু এই বদান্যতা ও আচার আচরণের ব্যবহার কতটুকু করা সম্ভব এইদেশে। কারণ এইখানে ক্ষমতার প্রাকটিস ও শো-অফ একটু বেশি। তাছাড়া মানুষের মধ্যে রয়েছে সহনশীলতার চরম অভাব। তারপর কয়েকবছর ট্রাফিক ও ফাঁড়িতে চাকরি করে ২০১৫ সালে আবার মিশনে যাই। কিন্তু এইবার যাই দারফুর, সুদানে। অত্যন্ত গরম আবহাওয়া। দিনের বেলায় প্রায় ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, তাও আবার মরুভূমিতে। ডিউটিতে যেতাম ২০ কেজি ওজনের একটা বুলেট প্রুফ ভেস্ট পড়ে। গাড়ি থেকে নামলেই মনে হতো শরীরে কেউ জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি মেরে দিচ্ছে। জঙ্গীগোষ্ঠী জানজাওয়িডের আতংক আর আবহাওয়ার অত্যাচার, দুই মিলে জীবন বড়ই কষ্টের ছিল। তারপরও সেইখানে থাকা আইডিপি কিংবা রিফিউজিদের আচরণ দেখে মুগ্ধ হতাম। আমাদের কাজ ছিল ওইখানের পুলিশ এবং আইডিপি কিংবা রিফিউজিদের রিফর্ম করা।
সপ্তাহে একদিন বাজার বসত। বাজার থেকে প্রোটিন বলতে গরু, ছাগল আর মাঝে মাঝে মুরগী পাওয়া যেত। গরু ও ছাগলের মাংস কিনতে গিয়ে খুব অবাক হতাম কারণ তারা গরু বা ছাগল জবাইয়ের পর মাংস কেটে রোদে রেখে দিত। একটুও পানি দিত না। তাই বাংলাদেশের হিসেবে ১ কেজির ওজনে ১.২৫ কেজি মাংস পাওয়া যেত। মাংস নেয়ার পর সবাইকেই আরো ২ পিস ফ্রি দিত। তদ্রুপ পেঁয়াজ কিনলেও দুইটা পেঁয়াজ বেশি দিত। তখন হতবাক হতাম যে, এতো গরীব দারফুর প্রদেশের মানুষ, তারপরও মন কত বড়! সবচেয়ে অবাক হই রোজার মাসে যখন দেখলাম সবকিছুর দাম অত্যন্ত স্থির, কিছু কিছু জিনিসের দাম অপেক্ষাকৃত কম।
তাদের দেখেও নিজের দেশের রোজার মাসের সিন্ডিকেটের কথা মনে হলো আর লজ্জিত হলাম।
রোজা মানে সংযম, রোজা মানে বিরত থাকা। পানাহার, গালিগালাজ, গীবত সবকিছু থেকেই নিজেকে বিরত রাখা।
কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র।
রোজা আসলে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে, মানুষ ঝগড়াঝাঁটি বেশি করে, অসহনশীল আচরণ করে।
তারই উদাহরণ দেখলাম অদ্য ১৮/১০/২০২১ খ্রিস্টাব্দতে। কিসের এতো অহংকার আমাদের। নিজেদেরকে আশরাফুল মাখলুকাত মনে করি কিন্তু আচার আচরণে নিকৃষ্টতম প্রাণীর উদাহরণ দিয়ে বেড়ায়।
করোনাকালীন কয়েকটা সরকারি সংস্থাই শুধু নিজের জীবন দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তার মধ্যে পুলিশ, ডাক্তার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা অন্যতম।
কিন্তু আজকে যে ঘটনা দেখলাম তা রোজার পবিত্রতা ও করোনাকালীন আমাদের ত্যাগ তিতিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে কিনা!
মোবাইল কোর্টে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুলিশকে নিয়ে একটি গাড়ি আটকে সাদা এপ্রোন পড়া ভদ্রমহিলাকে আইডি কার্ড দেখাতে বলায় তিনি অত্যন্ত চড়া গলায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
এইখানে দুইপক্ষই সহনশীলতা দেখাতে পারত। ডাক্তারের গাড়িতে বিএসএমএমইউ এর মনোগ্রাম চিহ্ন ও গায়ে এপ্রোন দেখে আইডি কার্ড না দেখে কিছুটা এড়িয়ে যেতে পারত কিন্তু যেইখানে পুলিশ, র্যাব, ম্যাজিস্ট্রেট, এমনকি আর্মির পোশাকও নকল করে মানুষ অহরহ আকাম করছে আবার ধরাও খাচ্ছে সেইখানে একজন ডাক্তারের কাছে শুধু আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আইডি কার্ড চাওয়ার পর এতো কথা না বলে যদি তিনি বলতেন যে, আইডি কার্ডটি ভুলে বাসায় ফেলে এসেছেন তাহলে উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ও পুলিশ সদস্যরা ওনাকে অবশ্যই ছাড় দিত।
কিন্তু তিনি তা না করে ওনার স্ট্যাটাস, উনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ওনার স্ট্যাটাস সেক্রেটারি লেভেলের ইত্যাদি কথা বলে নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাস্যরসের পাত্র না বানালেও হতো। তাছাড়া একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছ থেকে আমরা আরো মার্জিত ভাষা আশা করি।
যাই হোক, দোষ উভয় পক্ষেরই আছে, যদি উনি ডাক্তার পরিচয় দিয়ে থাকেন তাহলে ওনাকে একটু ছাড় দেয়াই উচিত হতো। আবার আইডি কার্ড চাওয়ার উনি যে আচরণ করেছেন তাও অত্যন্ত আপত্তিকর।
সবচেয়ে বড় কথা, এই করোনা মহামারীর সময় যেইখানে এই ৩টি সংস্থা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে সেইখানে তারা পাবলিকলি বাকযুদ্ধে লিপ্ত। একেকজন নিজেকে জাহিরে ব্যস্ত।
পুলিশের প্রায় ৯০ জন সদস্য এই করোনায় শহীদ হয়েছেন। তাছাড়া প্রায় ১৬০০০ করোনা পজিটিভ হয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশ সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কখনো পিছপা হয়নি আর হবেও না।
জাতি হিসেবে আরো বেশি পরিপক্ক হওয়ার দরকার আছে আমাদের। না হলে বহিঃবিশ্বও আমাদেরকে নিয়ে সারাজীবন হেসেই যাবে।।
দায়িত্বশীলতা মানুষকে ভদ্র ও মার্জিত বানায়। আসুন আমরা সবাই ক্ষমতার দম্ভ থেকে বেরিয়ে আসি। পরকালের ডাক কিন্তু একদিন আসবেই।
লেখক:
ইমরানুল হক মৃধা
লক্ষ্মীপুর সদর
ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই)
Leave a Reply